• ঢাকা
  • |
  • শুক্রবার ২১শে অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বিকাল ০৫:০৯:১৮ (05-Dec-2025)
  • - ৩৩° সে:
সংবাদ ছবি

পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিনে ৯ হাজার বাসিন্দার মানবেতর জীবন-যাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপ।১৬ দিন অতিবাহিত হলেও 'বিধিনিষেধ'-এর বেড়াজালে প্রবাল দ্বীপটির উদ্দেশ্যে এখনও শুরু হয়নি জাহাজ চলাচল। ফলে সেন্টমার্টিন আজ পর্যটকশূন্য, নীরব ও নিঃসঙ্গ। একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন শত শত পর্যটকে মুখরিত থাকত এ দ্বীপ। আর এখন সেখানে নেমে এসেছে নীরবতা, হতাশা আর অনিশ্চয়তার ছায়া।পর্যটন মৌসুমের শুরুর দিকে প্রশাসনের অনুমতি সত্ত্বেও কোনো পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল না করায় কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দ্বীপটি। পর্যটকের আগমন বন্ধ থাকায় হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, পরিবহন—সবখানেই নেমে এসেছে স্থবিরতা।দ্বীপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জেটিঘাট এখন প্রায় জনশূন্য। আগে যেখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পর্যটকে মুখর থাকত, এখন সেখানে ভাসছে নির্জনতা। চারপাশে শুধু সমুদ্রের গর্জন আর দ্বীপবাসীর নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।দ্বীপের স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, জেটিঘাটে আমার তিনটি দোকান আছে, ৫ জন কর্মচারীও রেখেছিলাম। কিন্তু এখন দোকান ভাড়া তুলতে পারি না, কর্মচারীদের বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছি। একবেলা খেলে আরেকবেলা খাওয়া হয় না। এমন অবস্থায় টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।একই কষ্টের কথা শোনালেন স্থানীয় বাসিন্দা আরিফ উল্লাহ । তিনি বলেন, গত বছর মাত্র দুই মাস পর্যটন মৌসুম পেয়েছিলাম। ওই সময়ের আয় দিয়েই তিন-চার মাস সংসার চলেছে। তারপর থেকে আয়ের সব পথ বন্ধ। এখন পুরো পরিবার নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছি।স্থানীয় ইজিবাইক চালক মোহাম্মদ কেফায়েত বলেন, পর্যটক না থাকায় সারাদিন গাড়ি চালিয়েও ব্যাটারি চার্জের খরচ ওঠে না। প্রতিদিন ৫০০ টাকা খরচ, আয় হয় মাত্র ২০০ টাকার কম। এখন গাড়ি চালানো মানে লোকসানের খাতায় নাম লেখা।বর্তমানে দ্বীপে দুই শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কিন্তু পর্যটক না থাকায় সবকিছু প্রায় বন্ধের মুখে।সী প্রবাল বিচ রিসোর্টের পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, হোটেল-মোটেলগুলো এখন প্রায় খালি পড়ে আছে। বুকিং নেই, কর্মচারীরা বেকার বসে আছে। জাহাজ কবে চলবে, সেটাও অনিশ্চিত। আমরা ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।সেন্টমার্টিন হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি এম এ রহিম জিহাদী বলেন, সরকারের নির্দেশনায় নভেম্বর থেকে পর্যটকরা দ্বীপে যেতে পারবেন, কিন্তু রাতে থাকতে পারবেন না। এতে আগ্রহ হারাচ্ছেন পর্যটকরা। আবার জাহাজ না চলায় ভ্রমণই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে দ্বীপের প্রায় সব মানুষ এখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির ওপর টিকে থাকা সেন্টমার্টিনে এখন এক ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, দ্বীপের ৮০ শতাংশ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত।সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন, মানুষের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন, যারা আছেন তারাও কষ্টে দিন পার করছেন। যদি দ্রুত জাহাজ চলাচল শুরু না হয়, তাহলে বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে৷পরিবেশবিদদের মতে, অতিরিক্ত পর্যটন ও অব্যবস্থাপনা সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তাই টেকসই পর্যটনের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা জরুরি হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা রক্ষায় সুষম নীতি গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ক্ষুদ্র দ্বীপে বসবাস করেন প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষ। প্রবাল, নারিকেল গাছ, নীল জলরাশি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেন্টমার্টিন এখন পরিণত হয়েছে এক নীরব ও অনিশ্চিত দ্বীপে।দ্বীপবাসীর মুখে এখন একটাই প্রশ্ন—‘কবে আবার ফিরবে সেই প্রাণচঞ্চল পর্যটনের দিনগুলো?’এদিকে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ঘাট থেকে সেন্টমার্টিন পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আইনগত বিধিনিষেধ থাকায় কক্সবাজার ইনানী নৌবাহিনীর ঘাট থেকে পর্যটনবাহী জাহাজ সেন্টমার্টিন যাওয়ার সুযোগ নেই।সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে নীতিগত সম্মতি দিয়ে পাঠানো চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে পাঁচটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।চিঠিতে বলা হয়েছে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছে।ইসিএ এলাকায় কক্সবাজার পৌরসভা (রাজস্ব বিভাগের রেকর্ড করা সমুদ্র সৈকত বা বালুচর বা খাড়ি বা বন বা জলাভূমি) এবং ইনানী মৌজা ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ অন্তর্ভুক্ত।বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০)-এর ৫(৪) ধারা অনুযায়ী, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করা এলাকায় কোনো ক্ষতিকর ‘কর্ম বা প্রক্রিয়া’ চালু রাখা বা শুরু করা যাবে না।রাত্রিযাপনের সুযোগ না থাকায় এই মাসে পর্যটক সংকটের ফলে জাহাজ চলাচল সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সী ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর।তিনি বলেন, আমরা সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম জাহাজ ছাড়ার, কিন্তু দিনে এসে দিনে ফিরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতায় পর্যটকদের অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে, ফলে আমরা এ মাসে সেন্টমার্টিন যাত্রা পরিচালনায় বিরত থেকেছি।বাহাদুর আরও বলেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে রাত্রীযাপনের সুযোগ থাকায় ১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ স্বাভাবিকভাবে চলাচল করবে।এই পর্যটন উদ্যোক্তা বলেন, পর্যটন শিল্পের স্বার্থে বিধিনিষেধ শিথিল হলে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। এক্ষেত্রে সরকারের সদয় দৃষ্টি প্রত্যাশা করেন তিনি।